Literary World

সাহিত্য ভুবন

Humorous Pieces

বিকাশে টাকা ধার

চিরহরিৎ

ষোলতলার কাঁচে ঘেরা আধুনিক অফিস থেকে ঢাকা শহরটা মন্দ নয়। একদিকে ফার্মগেইটের দৃষ্টিনন্দন ব্যস্ততার দৃশ্য, অন্যদিকে পান্থপথের সিগন্যাল, সবিই নখদ দর্পনে, জনি সাহেবের। ইদানিং, চব্বিশ ইঞ্চি ডেল-মনিটরে “আমজনতা ২০২১” অনলাইন পেপারটিতে চোখ রাখতেও প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে, জনি সাহেবের। তাই একটি সিগারেট ধরাবেন বলে, প্রায় ছ-ফুট মানুষটা যখন চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে পেছনে তাকালেন, তখন আর না-হেসে পারলেন না। কারণ তার চোখের সামনেই ভেসে উঠলো, আখলাস সাহেবের শিশুসুলভ হাসিখুশি মুখ। আখলাস সাহেব তার পবিত্র চাপদাড়িতে হাতবুলিয়ে প্রশ্ন করলেন,‘ সাতটার আগেই কি নিউজ আপলোডিং শেষ হয়ে যাবে?’

জনি সাহেব প্রতুত্তরে আরও সুন্দর হাসি দিয়ে বললেন, ‘রাত দশটা লেগে যাবে।’ তাহলে এককাজ করেন, আপনি চাবির তোড়াটা রাখেন, যাওয়ার সময় শাটারটা টেনে বড় তালা দুটো লাগিয়ে দেবেন, আখলাস আহমেদ বললেন। তারপর লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি আবার কিছু একটা ভেবে অফিসের দোরগোড়ায় ফিরে এলেন আর জনি সাহেবকে বললেন,‘তালাগুলো ঠিকভাবে লাগলো কিনা ভালোভাবে টেনে দেখবেন। আবার সেদিনের মতো ভুল করবেন না যেন’ বলতেই জনি সাহেব বললেন,‘কি যে বলেন, আর কখনও ভুল হবে না, ব্রাদার।’

আখলাস আহমেদের প্রস্থানের পরপরই, জনি সাহেব অ্যাকাউন্ট-ম্যানেজার মিথিলা ম্যাডামকে ডাকলেন। মিথিলা তার বয়-ফ্রেন্ডের সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলতে, জনি সাহেবের ডেস্কের সামনে এসে চোখের ইশারায় কিছু একটা জানতে চাইলেন? জনি সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু টাকা হবে?’ প্রতুত্তরে মিথিলা চৌধুরী এমন একটি এক্সপ্রেশান দিলেন, যেন তিনি প্রশ্নটার কথা আগে থেকেই জানতেন এবং বিরক্তির সাথে না-সূচক অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলেন। আসলে অফিসের সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ মানুষটি অর্থাৎ ‘আহসানুল করিম ওরফে জনি সাহেব’ টাকা ধার নিতে নিতে, এমন একটি নজির রেখে গেলেন যে অফিসের আয়া থেকে শুরু করে এমডি সাহেব, অর্থাৎ আখলাস আহমেদের মতোন ভদ্র, নম্র, বিনয়ী মানুষের পকেটের অবস্থাও শূণ্য করে ছেড়েছেন।

গেল সপ্তাহের মিটিং-এ মিথিলা চৌধুরী, জনি সাহেবের নামে প্রায় একলাখ চল্লিশ হাজার টাকা অগ্রিম বেতন হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। হিসাবটা শুনে আখলাস আহমেদ, জনি সাহেবকে ডাকলেন আর কফি খেতে খেতে, মুখে মৃদু হাসি রেখে বললেন, এভাবে চললে কিন্তু আমরা, আপনার অনলাইন পেপারের প্রজেক্টা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো। উত্তরে, জনি সাহেব বললেন, ‘আসলে আমার ওয়াইফ চলে যাবার পরে প্রচুর ধারকর্য হয়ে গেছে তো, তাই ধারগুলো পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি, আমি কথা দিচ্ছি আগামীতে আর হবে না।’

আখলাস আহমেদ হেসে বললেন, ‘অনেকদিন তো ভাবীর আয় দিয়ে চললেন, এখন ভাবী যেহেতু চলে গেলেন, নিজের রোজগার দিয়ে চলেন। তারপর আবার থেমে বললেন, ও আপনিতো আবার বিয়ে করেছেন।’ এমন দীর্ঘ নিঃশাস ছেড়ে কথাটা তিনি বললেন, তাতে তার ৪৩ বছর বয়সেও চিরকুমার থাকার অভিমানটা প্রতিফলিত হল মুহূর্তেই।

ড্রইং-রুমের বেতের চেয়ারে বসে বসে বনশ্রীর এই দৃশ্যপটটা মন্দ নয়। তাই সময়টা উপভোগ করার জন্য, জনি সাহেব অতি যত্নে পাঞ্জাবী থেকে বেন্সন লাইট সিগারেটটি ধরালেন আর ক’টি সুখটান দিতেই, অধরা, মানে তাঁর নতুন স্ত্রী সিগারেটটা মুখ থেকে বারান্দায় ছুড়ে মারলো। আর শাড়ীর আঁচলটা কোমড়ে পেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ‘শালা বুড়া বেটা, মরদ নাই আবার বিয়ে করলি ক্যান? তোর মতো আরেকটা বুড়ি হলেও তো জুটাতে পারতি। হারামজাদা করলি তো করলি, আমার মতো কচি মাইয়ারে করলি।’

চির ভদ্র জনি সাহেব পরিস্থিতিটাকে শান্ত করার জন্যে তার দেড় বছরের শিশুকন্যা নিটোলকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠলেন। সেটি দেখে অধরা ভেঙচি কেটে বাজারের থলেটা ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ‘যাও কপর্দকহীন তোমার ঐ ধনটা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কিছু বাজার নিয়ে আসো।’

সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে, জনি সাহেব থমকে দাঁড়ায়, তারপর কিছু একটা ভেবে সেই মেডিক্যাল কলেজের বন্ধু, ডাঃ ইমরুল হাসানকে ফোন করলেন। অনেক দিন পর হোস্টেল জীবনের বন্ধু জনির সব কথা শুনে, ডাঃ ইমরুল বললেন, ‘আমি এখনই তোমার এই বিকাশ নাম্বারে দশহাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি পারো টাকাটা আগামী মাসেই পাঠিয়ে দিও, চারিদিকে যে হাহাকার লেগেছে, বন্ধু।’

জনি সাহেব খরচ সমেত নগদ ১০,২০০ টাকা পেয়ে ইচ্ছেমত বাজার করলেন। তারপর দু’দুটো বাজারের থলি সহ একজন মুটের ভাঁড়ে মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি প্রভৃতি সব্জি তুলে দিলেন।

বাসায় কলিংবেল দিয়ে দরজায় অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, অধরা যখন দরজা খুললো, তখন তিনি তাকে দেখেও না দেখার ভাব করলেন এবং তাঁর খাড়া নাকটাকে উর্ধ্বমূখী করে এমন ভাব করলেন যেন এরকম রাজকীয় বাজারসাজার করা তাঁর জন্য অতি মামুলি ব্যাপার।

অধরার খুশি আর দেখে কে, এমনিতেই দেশগ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে, শহুরে মানুষদের আরাম আয়েশের কথা শুনেছে কেবল কিন্তু এই প্রথমবার পরখ করলো। দুপুরে পেট ভরে ইলিশ ভূনা দিয়ে ঘন-ডাল খেয়ে একটা হালকা ঘুম মারার পর, আয়েশ কাটাতে হাতপাগুলো চারদিকে ছুঁড়তেই, অধরা হাজির হল পায়েশ নিয়ে। জনি সাহেব এবার তাঁর কচি সুন্দরী বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললো, যাও রেডি হয়ে নাও, আজ আমরা হাতিরঝিলে ঘুরতে যাবো। রেডি হতে অধরার বেশিক্ষণ লাগলো না (গ্রামের মেয়ে বিয়ে করলে এই এক সুবিধা, জনি সাহেব মনে মনে ভাবলো), সে গত ঈদে কেনা কালো জামদানিটা জড়িয়ে আগে আগে চলতে লাগলো। আর তার পিছু পিছু কন্যা সমেত লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে চলছেন, জনি সাহেব। এক সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর পিছু পিছু কন্যা সমেত বয়স্ক স্বামী, দৃশ্যটা দেখে পাড়ার বখাটেরা ভেঙচি কাটলেও, জনি সাহেব সেই সব অপ্রাসঙ্গীক বিষয়গুলো অতোটা গায়ে মাখান না, তাঁর প্রসঙ্গ একটাই কিভাবে বিকাশে আরও বেশি বেশি অর্থ আমদানি করা যায়।

বাসায় ফিরে জনি সাহেব এবার বউকে আদেশের সুরে বললেন, ড্রয়ার থেকে আমার খাতা-কলম এনে দাওতো। বলার সঙ্গে সঙ্গে অধরা খাতা-কলম নিয়ে হাজির। এবার তিনি শেয়াল পণ্ডিতের মতন রিডিং চশমাটা জড়ালেন আর খাতা থেকে মাথাটা ইষৎ উঁচু করে ফিস ফিস করে বললেন, ঘন লিকার মিশিয়ে এককাপ দুধ চা নিয়ে আসো যাও, অধরা রান্নাঘর মুখী হতেই, জনি সাহেব তার নরম হাতটি স্পর্শ করে বলে ওঠে, আসার সময় ডাইনিং টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটাও নিয়ে এসো।

অধরা আসলো মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে, সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বেন্সন-লাইট বের করে নিয়ে সে জনি সাহেবের ফোকলা মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে লাইটার দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল আর হাসতে হাসতে জাবর কাটতে কাটতে বলতে লাগলো, ‘এই তিতা সিগারেটটা খেয়ে, আপনারা পুরুষ মানুষরা কী মজাটা পান?’

জনি সাহেব, অধরার মিষ্টি হাসিটা দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না, তাই চপাশ চপাশ শব্দে দুটো চুমু বসিয়ে দিলেন স্ত্রীর তন্নী দু’গালে। অধরাও আবেগপ্রবণ হয়ে কাছে আসতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। অধরা নিজেকে স্বামীর বাহু মুক্ত করে দরজা খুলতেই দেখে, দরজার সামনেই ঠাই দাঁড়িয়ে আছে, তার মা, বাবা আর তার চাচাতো বোন মিনা। মায়ের হাতে বিশাল একটি টিফিন-ক্যারিয়ার, বাবার হাতে দুদুটো বাজারের থলে আর মিনার কোলে একটি লাল মোরগ, মিনা ফিসফিস করে, অধরার কানে এসে বলে, ‘তোমাকে না আইজ খুব সুন্দর লাইগতাসে’ বলতেই দুইবোন সজোড়ে হেসে উঠে। বাড়িতে শ্বশুর পক্ষের মানুষদের আনাগোনা দেখে, জনি সাহেব মৃদু হাসলেন. তারপর মনের মাঝে অতি প্রত্যয় জুড়িয়ে এমনভাবে নাকটাকে উঁচু করলেন যেন তিনি এই পৃথিবীর কেউ নন, সোজা মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছেন। জামাইবাবুর নাকের ডগাই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখে, অল্পবয়সী শাশুরি হাত পাখা দিয়ে এক্সট্রা বাতাস দিতে লাগলো আর বললো, ‘আপনি যে আমার মাইয়াটারে এতো সুখে রাখলেন, সেই জন্য সামান্য টাকাটা দিলাম।’ জনি সাহেব এবার তার মনোযোগটা তার সূঁচালো খাড়া-নাক থেকে সরিয়ে বাস্তবতায় ফিরে এলেন এবং হাতের মুঠোয় কড়কড়ে পাঁচ, পাঁচটি একহাজার টাকার নোট পেয়ে বিনয়ের ঢঙ্গে কাচুমাচু করে বলতে লাগলেন, ‘কি দরকার ছিলো, বলতে বলতে তিনি অধরাকে ডেকে তার হাতে টাকাগুলো তুলে দিলেন।

শ্বশুরপক্ষকে গাজীপুরের এসি বাসে তুলে দিয়ে, জনি সাহেব, বিশ টাকা দিয়ে একটি স্বনামধন্য ওষধ কোম্পানির নামে ছাপানো প্যাড কিনলেন তারপর তাঁর অসমাপ্ত মেডিকেল জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে রামপুরা টিভি স্টেশনটা কখন যে ফেলে গেলেন, নিজেও টের পেলেন না। এবার সামনে একটু এগিয়ে ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসলেন। একটা বেন্সন-লাইট ধরিয়ে একটি কফি মিশ্রিত চায়ের অর্ডার দিলেন। দোকানি চা দিতে দিতেই, তিনি খাতায় প্রায় দশজন ডাক্তারি পড়া বন্ধুর নাম লিখে ফেললেন। হঠাৎ কাঁধে একটি অপরিচিত হাতের স্পর্শ আর অচেনা এক কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তিনি আঁৎকে উঠলেন আর দেখলেন, সেটি তাঁর বাল্যবন্ধু ও পরবর্তীতে নেশার পার্টনার আবুল হোসেন ওরফে তাজুল। যার সঙ্গ ত্যাগ করার জন্যে তিনি একদা চট্টগ্রামের মায়া ছেড়ে ঢাকায় ডেঢ়া বেঁধেছিলেন। কেমন আছো বন্ধু? শুনলাম তুমি নাকি দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছো? আর কি করবো বন্ধু, ভাগ্যে যা লেখা ছিলো, তাই ঘটলো, জনি সাহেব মৃদুভাবে উত্তর দিলেন। আড্ডা চলতে লাগলো প্রায় রাত এগারটা অব্ধি, এরই ফাঁকে ধুরন্দর জনি, তাজুলের কাছ থেকে তাঁর স্কুল ও মেডিকেল জীবনের প্রায় শ’খানেক বন্ধুর নাম, ফোন নাম্বার ও পদবী লিপিবদ্ধ করলেন। রাত সোয়া এগারটায়, অধরার ফোন আসার পর পর, জনি সাহেব, তাজুলকে বিদায় জানিয়ে ঘরমূখী হলেন।

পরের দিন শনিবার, জনি সাহেব একটু দেরিতেই অফিসে পৌঁছালেন, আখলাস আহমেদ কিছু একটা বলতে গিয়েও প্রসঙ্গটা অন্যদিকে নিয়ে বললেন, কিছু নিউজ ফরওয়ার্ড করেছি, আপনার মেইলটা চেক করে দেখেন। জনি সাহেব, সুবোধ বালকের মতন কেবল মাথাটা নাড়ালেন। তবে একটা বিষয় অফিস পাড়ায় সবাই বুঝতে পারলো যে, জনি সাহেব আর সেই জনি সাহেব নেই; আগে যেরকম জনি সাহেবকে দেখলে একটা ক্ষুধার্ত মুখের কথা ভেসে উঠতো এখন তার পরিবর্তে মুখে কিছুটা চর্বির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, সেই সাথে ঘামের স্রোতে তেল যেন উপচে পড়ছে, কলপ করা ঘন চুল থেকে। অফিসের আয়া, মপার দিয়ে অফিস ফ্লোর মুছতে মুছতে, মিথিলা ম্যাডামের টেবিলে গা এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘বুঝলে আপামণি, ব্যাডার মনে হয় আবার নতুন করে রঙ লাইগসে: হেই ব্যাডা আর সেই ব্যাডা নাই।’ কথাটা শুনে মিথিলা হাসতে হাসতে প্রায় হেলে পড়ে।

কথাটা যে জনি সাহেবের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি ঠিক তা নয়। বরং আয়া আর মিথিলার আলাপচারিতাগুলো শুনে, জনি সাহেব মুচকি হাঁসলেন তারপর রুটিনমাফিক তার খাড়া নাকটিকে উঁচিয়ে, মোবাইল ফোনের সেলফি মোডে গিয়ে, অধুনা গড়ে ওঠা নিজের নাদুস নুদুস গালের সেলফিটি ফেইসবুকে পোস্ট করলেন। পোস্টের কমেন্ট বক্সে তাঁর গুনধর বন্ধু তাজুল লিখলেন, ‘ব্যাটার নাকটা এতোটাই খানদানি যে, অন্য দশজন থেকে সহজেই আলাদা করা যায়।’ আর অধরা লিখলো, কার স্বামি দেখতে হবে না। শেষের কমেন্টি পড়ে, জনি সাহেব এতোটাই আশাবাদি হয়ে উঠলো যে, তিনি প্রায় তিনজন ডাক্তার বন্ধু আর তিনজন স্কুলের বন্ধুর কাছ থেকে বিকাশে আশি হাজার টাকা নিয়ে ছাড়লেন এবং সবাইকে আগামী তিনমাসের মাঝে টাকাগুলো ফেরত দিবেন বলে অঙ্গিকার করলেন। এদিকে এতোগুলো টাকা পেয়ে, জনি সাহেব টাকাগুলো খরচ করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলেন; তাড়াহুরো করে কাওরান বাজার থেকে চার হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ কেজি গরুর মাংস কিনলেন আর মনে মনে চার্বাকের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আওড়াতে লাগলেন, ‘ঋণ করে হলওে ঘি খাও, যত দনি বাঁচো সুখে বাঁচো ’। যাওয়ার পথে সিএনজি থামিয়ে ট্রান্সকমের শোরুম থেকে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে একটি ডিপফ্রিজ কিনলেন। তারপর মনে মনে নিজেকে বললেন, ‘এই জীবনে যতদিন বাঁচবি খেয়ে বাঁচবি। টাকা পয়সার কথা ভাবিস না, সেগুলো উড়ে উড়ে আসবে। ভাবতে ভাবতেই সিএনজি বাসায় এসে হাজির; কুলিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লো দোতলার সরু সিঁড়ি দিয়ে ফ্রিজটাকে তুলতে। অবশেষে রাত একটায় কুলিরা সফল হল ফ্রিজটাকে বাসায় তুলতে, তবে দুজন শ্রমিকের বড় রকমের জখমের বিনিময়ে। জনি সাহেব, তাঁর সদ্য গজিয়ে ওঠা চেক লুঙ্গিটা হালকাভাবে জড়িয়ে আহত শ্রমিকদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং তাদের দুজনকে একহাজার টাকা করে বক্সিশ দিলেন। তারপর অন্ধকার ঘরে, বউকে ডাকতে লাগলেন, সোনা সোনা বলে। ওদিকে অধরাও কম যায় না, সেও স্বামীর বুকে ফিরে আসে সদ্য কেনা কালো ফিনফিনে নাইট-গাউনটা জড়িয়ে।

এদিকে জনি সাহেব নিজেকে যতোটাই চালাক ভাবুক না কেন, তাঁর বিকাশ এপ্রোচের সারা দেয়ার সূচকটাও কিন্তু দিন দিন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে, অর্থাৎ আগে যেখানে তিনজনকে এপ্রোচ করলে একজনের কাছে ধার পাওয়া যেত, এখন সেখানে ছয়জনকে এপ্রোচ করলে একজনের সারা মেলে। তার ওপর আছে নানান রকমের কাচুমাচু, যেমন টাকা ধার দিতে ইতস্ত বোধ করা, ডিলে করা, মোবাইল কল রিসিভ না করা, অথবা এপ্রোচকারীর নাম্বার ব্লক করে দেয়া।

ওদিকে একটা কথা জনি সাহেবের বন্ধু মহলে ছড়িয়ে পড়লো যে, আসলে জনি সাহেব মোটেই কোন সাংবাদিক বা সম্পাদক গোছের কেউ নন, তিনি একজন মিষ্টিভাষি ফ্রড। কথাটা জনির অফিস পাড়ায়ও বাতাসের দোলায় আছড়ে পড়লো তাঁর হোস্টেল জীবনের বন্ধু, ডাঃ ইমরুল হাসানের বদৌলতে। ডাঃ ইমরুল যখন সরেজমিনে জনি সাহেবের অফিস অর্থাৎ ‘আমজনতা ২০২১’ ভিজিট করলেন এবং বুঝতে পারলেন যে অনলাইন পেপারটি মিডিয়া জগতের নবাগত শিশু ছাড়া আর কিছু নয় তখন তিনি চোখে রীতিমত শর্ষেফুল দেখলেন। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে মিথিলা ম্যাডামের সেবা না জুটলে আর আয়ার লেবুর শরবত না পেলে প্রায় প্রাণ যাওয়ার অবস্থা। তিনি হাউমাউ করে কান্না জুড়িয়ে আখলাস সাহেবকে বলতে লাগলেন, অনলাইন পেপারে আমার ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনের নামে সে নানান সময়ে প্রায় একলাখ টাকা হাতিয়েছে, তার ওপর ব্যাক্তিগত লোন নিয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ হাজার টাকা, আমার টাকাগুলোর কি হবে?

শান্ত হন ডাক্তার বাবু, আমার কিছু প্রশ্ন আছে, টাকাগুলো কি জনি সাহেব বিকাশের মাধ্যমে নিয়েছেন? একটা নয়, দু’টা নয়, তিন তিনটে বিকাশ নাম্বারে। আখলাস আহমেদ এবার নিজের পবিত্র দাড়িগুলোতে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন, আপনি কিন্তু টাকাগুলো আর ফিরে পাচ্ছেন না কারণ আমি জনি সাহেবকে অনলাইন পেপারটিতে কেবল নিউজগুলো আপডেট করার জন্য, যে বেতনটা দিই সেই বেতনে আগামী একশ বছরেও লোনগুলো রিকভার করতে পারবেন না।

বলেন কি, ডাক্তার ইমরুল বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কতটাকা বেতন তার? এই ১০ হাজার টাকা, আসলে আমার সাথে জনি সাহেবের চুক্তিটি ছিলো এরকম, পেপারটি কোনদিন দাঁড়িয়ে গেলেই কেবল, আমরা তখন জনি সাহেবের হ্যান্ডসাম একটা সেলারীর কথা ভাববো। আসলে পেপারটি যখন শুরু করি তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন অসহায়, বেকার, কৃতদ্বার; সমস্যাটা হচ্ছে, এখন তিনি বিয়ে করেছেন, বাবা হয়েছেন। জীবনের তাগিদেই একধরণের স্খলন, এই আরকি বলে, আখলাস আহমেদ আবার তাঁর দাড়িতে হাত বুলালেন।

যতো বিপদেই থাকুক না কেন, জনি সাহেব কিন্তু নিজেকে একজন সফল ব্যাক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কারণ তিনি তার অল্প বয়সি স্ত্রী, অধরা সুন্দরীর মনটা ঠিকই জয় করতে পেরেছেন, সেটাই বা কম কিসের একজন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মানুষের জন্যে। তিনি সুমধুর কণ্ঠস্বর দিয়ে স্ত্রীকে ডাকলেন, অধরা, অধরা। অধরা স্বামীর হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে পাশে এসে বসলো আর বললো, কী গো কোন সমস্যা? জনি সাহেব গলাটা ঝেড়ে, মৃদু কণ্ঠে বললেন, আসলে চারিদিকে যে পরিস্থিতি, ঢাকা শহরে ঘর ভাড়া দিয়ে বেঁচে থাকাটা দিন দিন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

হুনসি, দেশে নাকি রিজার্ভের অভাব?

হ্যাঁ, তুমি কেমনে জানলে?

ক্যান, ইদানিং ফেইসবুকে, পেপারে বিষয়গুলো নিয়ে তো হরহামেষাই আলাপ চলছে। জনি সাহেব, সুন্দরী স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তা দেখে বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং সুযোগ বুঝে নরম গালে দুটো চুমুও বসিয়ে দিলেন। তারপর হাতের মুঠোই অধরার কালো চুলগুলোতে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, আসলে আমারও হয়েছে তাই, রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। তাছাড়া-----

থাক আর বলতে হবে না, আমি বলতে সাইকি, আমনে আমার সাথে গেরামে সলেন, দুজনে মিইল্লা হাঁস মুরগী পালমু আর বাজারে বিক্রি করমু বলে, জনি সাহেবের গালে একটা ভেজা চুমু বসিয়ে দিলেন। কামুক স্ত্রীর, কামুক চুমুটা খেয়ে, জনি সাহেব, আত্মগর্ভে নাকটাকে উঁচু করতে গিয়ে ফিস করে একটি শব্দহীন অতি গন্ধযুক্ত মিষ্টি বায়ু নির্গত করলেন। প্রথমে অতি মধুর লাগলেও, পরে বিষাক্ত সাধ টের পেতেই, অধরা স্বামীর জন্য বেলের জুস বানিয়ে আনলেন। বেলের শরবতটি গলাধারণ করে, জনি সাহেব, অনেকটা হেলে দুলেই কমোডে বসলেন এবং স্বশব্দে আবর্জনা ত্যাগ করতে লাগলেন, শেষের বায়ুর আওয়াজে শিশুকন্যা নিটোলের ঘুম ভাঙলো এবং তার বিদগ্ধ গন্ধে, অধরার প্রায় মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা। যাক সেটিই ছিলো, জনি সাহেবের ঢাকা শহরে কাটানো শেষদিন। পরের দিন তিনি, বুকফুলিয়ে, নাকফুলিয়ে বাংলার ভেনিস সদৃশ্য মুন্সিগঞ্জে পারি জমালেন।

১২ই নভেম্বর, ২০২২

ক্যানডেয়িান ইদ্রিসের দেশে ফেরা

চিরহরিৎ

ইদ্রিস সাহেব চট্টগ্রামে বেড়াতে এসেছে প্রায় বছর দেড়েক পরে। নিউমার্কেটের মোড়ে দাঁড়িয়ে উত্তপ্ত আকাশটাতে চোখ রাখতেই, সে হাঁপিয়ে ওঠে। সে আঞ্চলিক ভাষায় গ্রীষ্মের গরমকে উদ্দেশ্য করে বলে, মাইল্লেফিরের গরম। ‘মাইল্লেফির’ এর অর্থটা যে কি, সে নিজেও জানেনা। তবুও সে গালিটা ছুঁড়ে দিয়ে রাস্তার মানুষের ভীড়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তৃপ্তির হাসি হাসে। আর মনে মনে ভাবে, শালা তোরা আসলেই কুত্তার বাচ্চা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দুনিয়াটা দেখলি না। আর এই যে আমি ‘ইদ্রিস মিয়া ওরফে ইদ্রিচ্চে’, বাংলাদেশকে চালিয়ে খেয়ে, কানাডায় ডেড়া বাঁধলাম। ইদ্রিস এবার মনের অজান্তেই তার সাদা টিশার্টের গায়ে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দেয়, তাতে ঘামে ভেজা গেঞ্জিটার ভিতর থেকে বিশাল ভুড়িটা জিন্সপ্যান্ট থেকে উপচে পড়ে নির্লজ্জ ভাবে।

উল্টোদিক থেকে হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ইদ্রিস, ফ্যাট ইবে এত্তোর কা অইয়ি তোঁয়ার?( পেটটা এতো বড় হলো কেন তোমার?)

ইদ্রিস, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তরে কয়েকবার ঘাড় নাড়াতেই, ধপাশ্ করে শুকনো একটি হাত, তার ঘাড়ে আলতো ভাবে আঘাত করে বসে। শুকনো, বাঁকানো লোকটার মরা চোখগুলো, ইদ্রিসের মনে ভয় ধরিয়ে দেয় তাৎক্ষণিক ভাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে আবিষ্কার করে, এটা হলো তার স্কুল জীবনের বন্ধু, আবুল বশর যাকে সবাই ‘মাদ্দো’ বলেই সম্মোধন করতো।

মাদ্দোঃ কবে এসেছিস?

ইদ্রিসঃ এইতো, গত পরশু।

দুই বন্ধু ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়ে পুরনো হোটেলটির সামনে , গরম গরম পরটা ভাজা হচ্ছে বিশালকায় কালো তাওয়ায়। ইদ্রিসের জীভে পানি চলে আসে, মাথার ভিতরে ফুটে ওঠে সদ্য ভাজা ডিমপোসের ছবি। সে নুইয়ে পড়া মাদ্দোর, মরা হাতটিকে টেনে নিয়ে হোটেলের ভিতর ঢুকে পড়ে, তারপর বলে ওঠে, কি খাবি? মাদ্দো তখন গরুর কালাভুনার স্বপ্নে বিভোড়, সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, গরুর কালাভুনা।

ইদ্রিসঃ এই বয়সে গরুর কালাভুনা খাওয়াটা কি উচিত হবে?

মাদ্দোঃ উচিত-টুচিত বুঝিনা, যেটা খেতে ইচ্ছে করছে সেটাই খাবো। .... আর কয়দিন বাঁচবো?

ইদ্রিস তার ছাত্রজীবনের নেতাগিরির কথা ভাবতে ভাবতে, সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বেয়ারাটাকে উদ্দেশ্য করে, গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘দুইটি ডিমপোস, একটি গরুর কালাভুনা আর চার পরটা।’ সদ্য ষাট পেরনো বেয়ারা, আবুইল্লে মাথা নাড়িয়ে হাঁ-সূচক ঈশারা দিয়ে, ঠ্যাং দুটো চেগিয়ে, চেগিয়ে রান্নাঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে।

এদিকে অর্ডারের খাওয়া আসতে দেরি হতে দেখে, দুইবন্ধু টেবিলে রাখা শুকনো ধইন্যাগুলো চিবোতে শুরু করে আর প্রতিবারের মতই তাদের আড্ডার বিষয়, ইসলাম, পশ্চিমা-বিশ্ব, ইজরায়েল এই তিন স্তরেই ঘুরপাক খেতে শুরু করে।

ইদ্রিসঃ বুঝলি মাদ্দো, বাংলাদেশে এসেছি কেবল দুটি উদ্দেশ্যে, মা-বাবার কবর জেয়ারত করতে আর হালাল খাবারদাবার গিলতে। শালার কানাডা সরকার, আমাদের যতই বেকারভাতা দিক, অমুক সুবিধা দিক; তারা আসলেই ইসলামের শত্রু। কোথায় যে কখন শুয়োর, বিভার গিলে ফেলছি, নিজেও জানিনা।

মাদ্দোঃ মুখের উপরের পাটিতে আটকে থাকা তরমুজের বিচি সদৃশ্য লালচে দাঁতগুলো বের করে বলে,‘আলহাম্দুলিল্লাহ্, তুইযে কানাডা গিয়ে খাঁটি মুসলমান বনে গেছিস তাতে আমার শুকনো কলিজাটা আজ জমজমের পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মারহাবা, মারহাবা এটাই তো মুমীনের চিহ্ন।’

ইদ্রিসঃ হাসতে হাসতে বলে, আমার একটাই স্বপ্ন, কখন কানাডাতে মুসলমানদের সংখ্যা খ্রীস্টানদের ছাড়িয়ে যাবে?

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই দুইবন্ধু ঝরো বাতাসের ভিতর আরেকটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ইদ্রিস ভাই------। ইদ্রিস উল্টো দিকে ফিরে দেখে, সেটা তার ছোট ভাই জাহেদ।

জাহেদঃ চলুন দাদা, আজকের লাঞ্চটা আমার বাসায় একসাথে সেরে নিই। জাহেদ আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ঐ যে দেখছেন হলদে টাওয়ারটা, ওটার চৌদ্দতলায় আমার বাসা। তার কথামতো দুই সত্তরার্ধো যুবক সুড় সুড় করে লিফটের সামনে জড়ো হয়ে পড়ে।

চৌদ্দতলার ফ্ল্যাটে পা রাখতেই ইদ্রিসের মন ভরে যায়, আলোকজ্জল বিশাল ড্রইং-রুমের চারদিকে খোলা জানালা, যেখান থেকে পুরো বন্দরনগরির সৌন্দর্যটাই ভেসে আসছে আসন্ন শীতের ছোঁয়ায়।

এখন কী পৌষ মাস? ইদ্রিস মিয়া, অতি উৎসাহ নিয়ে জাহেদের স্ত্রী, নন্দিনীকে প্রশ্ন করে। জী দাদা, এই গত পরশু থেকেই পৌষের যাত্রা শুরু হল মাত্র। বাঃ, কানাডায় বসবাস করলেও, বাংলাদেশের আবহাওয়াটা দেখি দাদার, নখদর্পনে।

দুজনের কথার ফাঁকে জাহেদ বলে, খবর না রাখলে কী দাদা, এমনি এমনি পঁয়ত্রিশ বছর বাটা কোম্পানীকে পরিচালনা করেছেন। ওদিকে, মাদ্দো বসেছিলো পূর্বমূখী জানালা দিয়ে, যেখান থেকে শহরের ব্যস্ততম রাস্তা স্টেশন রোড ও রিয়াজুদ্দিন বাজারের অলিগলিগুলি সহজেই চোখে পড়ে।

ইদ্রিস মিয়া, মাদ্দোর কাছে বসতেই, মাদ্দো তিন তিনবার আস্তাগফেরুল্লা উচ্চারণ করে। এই ঘরে কী ফেরেস্তা আছে? চারিদিকে মূর্তী আর মানুষের ছবিতে ঠাঁশা। মাদ্দো আরও উত্তেজিত হয়ে, চেয়ার থেকে উঠে দেয়ালে ঝুলানো রবীন্দ্রনাথের ছবিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘এই শয়তানের ছবিটা নামিয়ে ফেলতে বলতো, হারামজাদা আমার জাত শত্রু’ মাদ্দোর সাথে সুর মিলিয়ে, ইদ্রিসও বলে ওঠে, ‘জাহেদ দেয়াল থেকে ছবিগুলি নামিয়ে ফেল আর মূর্তীগুলো সরিয়ে ফেল, আমরা এখন নামাজ পড়বো।’

নন্দিনী পড়েছে বড় বিপাকে, সে তখন তার একমাত্র কন্যা রিমঝিমকে নিয়ে গান গাওয়াতে ব্যস্ত; জাহেদ তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, এখন গান বন্ধ করো।

কেন আমার বাসায়, আমি গান করবো তাতে ইদ্রিস দাদা অথবা ঐ মরা-বুইজ্জা মাদ্দোর কি? নন্দিনী এবার আরও দ্বিগুণ জোড়ালো কণ্ঠে গাইতে থাকে, ‘হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দেরে রে রে।’

গানে গুঁতো খেয়ে দুই টগবগে ষোত্তরার্ধো যুবক এবার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ইদ্রিস মিয়া বিশাল ভুঁড়িটা নিয়ে অতি কষ্টে সোফা থেকে উঠে, ছোট ভাইয়ের বেডরুমে ঢুকে অনাধিকার চর্চা করে বলে, ‘থামাও এসব নাফরমানি কাজ কারবার।’

ছিঃ ছিঃ দাদা, কানাডা গিয়ে আপনার এতো অধঃপতন। আগে আপনি, আমাদের বাসায় আসলেই আমার গান শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। এতো তাড়াতাড়ি সবই পাল্টে গেল।

পাল্টে যাওয়া রুপ, এখনও কী দেখলে? তোমার মতো হিন্দু ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে, আমি আগেই জাহেদকে নিষেধ করেছিলাম।

মুখ সামলিয়ে কথা বলবেন দাদা, আমি হিন্দু নই, মুসলিম নই, আমি মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমি আপনার ছোটভাইয়ের বউ। আমার ঘরের পরিবেশ আপনার ভালো না লাগলে, আপনারা অন্য কোথাও গিয়ে উঠবেন, ব্যস এ্ইতো সমাধান।

ওদিকে এতো ঝগড়া বিবাদের মাঝেও, আবুল বশর ওরফে মাদ্দো, টেবিলের গোরুর মাংসগুলো সব সাবাড় করতে ব্যস্ত। তাকে ভুড়িভোজনে ব্যস্ত দেখে, ইদ্রিস মিয়া বলে ওঠে, শুধু নিজের খেলে চলবে, বন্ধুর কথা একবারও ভাবলে না, আসলেই তোমার মত গোস্ত খাওয়া মুসলমান আমি এই জন্মে আর দেখিনি।

মাদ্দো হাসে, আর হাসলে তার তরমুেজর বিচি সদৃশ্য দাঁতগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর সেই ফোকলা গালের ভিতর থেকে পান খাওয়া টকটকে লাল জিব্বাটা দিয়ে সুরুত করে একটা শব্দ করে আর বলে, ‘আমার জন্মটাই হয়েছে দুনিয়াতে মাগনা খাওয়ার জন্যে। এই জীবনে কতো মানুষের ঘাড় ভেঙ্গে খেয়েছি, ইদ্রিস তোমার কি মনে আছে। আমার এক মামাতো ভাইয়ের কথা, যার নাম ছিলো ইমরান, খাতুনগঞ্জে যার গাড়ির ব্যবসা ছিলো। সে এখন কোথায়? কবরের ভিতর আর আমি মাদ্দো, এখনও দুনিয়াটা চালিয়ে খাচ্ছি। শালা ইমরাইন্নে জীবনে এক রাকাত নামাজও পড়েনি। তাই আমিই, আযরাইলের রুপ ধারণ করে তাকে ফকির বানিয়ে ছেড়েছি, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর বানিয়ে ছেড়েছি।’

কথাগুলো শুনে, ইদ্রিস মিয়া এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, ‘তুমি তো দেখি এক বিশ্ব বেহায়া, ছেলেকে প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়ানোর নাম করে যে, দশ লাখ টাকা নিয়েছিলে, সেই টাকাটার এক দশমাংশ কি পরিশোধ করেছো এখনও পর্যন্ত? আসলেই তুমিই হচ্ছো সাক্ষাত শয়তান, গরু খাওয়া মুসলমান। মুসলমানদের কলংক, যা তুই এখনিই বেরিয়ে যা এখান থেকে, কুলঙ্গা।’

কিন্তু দুই নাছোড়বান্দা বন্ধুর বন্ধুত্ব যেন, কখনও ভেঙ্গে যাওয়ার নয়। দু’জনের সামাজিক অবস্থান যতোটাই ভিন্ন হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ অথবা রুচিবোধের জায়গাটা আসলে পুরোপুরিই এক। একজন সারাজীবন বিআরটিসি, বাটা প্রভৃতি বড় বড় কোম্পানির ম্যানেজারের পদে থেকে কানাডার টরেন্টো শহরে থিতু হলেও, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির গোবর যেন তার জুতা জোড়াকে আজও ছাড়েনি। অর্থাৎ তিনি, যেখানে যেখানে গিয়েছেন সেখানেই তিনি বাংলাদেশের ঐ প্রত্যন্ত অঞ্চলের আধা গ্রামীন, আধা শহুরে মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সেই বিবেচনায় আবুল বশর মাদ্দো, ইদ্রিস মিয়ার চাইতে অনেক বেশি সলিড, হতে পারে তার সারাজীবনটাই কেটেছে কিছুটা অর্ধবেকার হয়ে, কিছুটা সুযোগসন্ধানী মজুদ্দার, ব্যবসায়ী হিসেবে কিন্তু তিনি অন্তত ঐ ইদ্রিস মিয়ার মতো হিপোক্রেট নন। ইদ্রিস মিয়া তাই জীবনের এই প্রান্তে এসে মাদ্দোর কাছে হার মানে, সেই সাথে মসজিদ-মাদ্রাসায় দান খয়রাত দিয়ে এই বাংলাদেশের মাটিতে মরার স্বপ্ন দ্যাখে।

চৌদ্দতলা থেকে নামতেই দুইবন্ধু, প্রাণ ভরে দুটি সিগারেট পান করতে থাকে। মাদ্দো বলে, ইলিয়াস তোমার কি মনে আছে সেই কলেজ জীবনে, আমরা দু’জন, দু’ভাগ করে কতো স্টার-সিগারেট টেনেছি। হ্যাঁ, মনে আছে বন্ধু, ঢেড় মনে আছে, বলতে বলতে ইদ্রিস পুর্বমুখী হয়ে একটি দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু নির্গত করে। মাদ্দো, ফোকলা দাঁতে বাঁকা হাসি মেরে বলে, কানাডা গিয়েও পুরনো অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারলে না? ফুটপাতের খাম্বাটা ধরে, ইদ্রিস মিয়া আরও একটি জঘন্য বায়ু নির্গত করে বলে, টরেন্টোতে গিয়ে খ্রীস্টানদের চার্চে, ক্যাথেড্রেলে ঢুকে ইচ্ছেমত গন্ধ ছড়িয়ে এসেছি বন্ধু।

কথাটা শুনে, মাদ্দো বলে ওঠে, সাবাস বন্ধু সাবাস, ঐসব নাফরমান্দের দেশে তুমি ঠিক কাজটিই করেছো; বলতে, বলতেই সেও খুশিতে আটখানা হয়ে, বিশাল খাম্বাটা জড়িয়ে বায়ুনির্গত করতে গিয়ে তার প্যাম্পার্সে নিঃশব্দে বিষ্ঠা জমে উঠে। আসে পাশে কোন বাথরুমের ঠিকানা না পেয়ে, ইদ্রিস মিয়া বলে ওঠে, ‘এ কেমন শহর নাগরিকদের জন্য কোন বাথরুমের ব্যবস্থা নেই, অথচ আমাদের টরেন্টোতে নাগরীকদের কতো সুবিধা, আরাম আয়েশ বলে শেষ করা যাবে না।’ বলতে বলতেই মাদ্দো ফুটপাতের মাঝখানেই বসে পড়ে, তার স্যুটের প্যান্ট থেকে থেমে থেমে গড়িয়ে পড়ছে, বুড়ো মাদ্দোর বিষ্টার স্যুপ। এক ঝাড়ু–দারনি এসে, ইদ্রিস মিয়ার কাছে একহাজার টাকা দাবি করে বসে, শুধু মাত্র মাদ্দোর স্যুট-কোট পানি মেরে আপাতত পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যে। অবশেষে, ইদ্রিস মিয়াকে আবার ছোটভাইয়ের দারস্ত হতে হল।

চৌদ্দতলার ফ্ল্যাটে পা দিতেই, ঝাড়ু– হাতে নন্দিনীর অগ্নিমূর্তী দেখতেই মাদ্দোর, মা কালীর কথা মনে পড়ে গেল, সে ভয়ে ড্রইং-রুমের ফ্লোরেই নুইয়ে পড়লো আর আস্তাগফেরুল্লা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। নন্দিনী আরও অগ্নিমূর্তী ধারণ করে, ইলিয়াস মিয়াকে বলতে লাগলো, দাদা, বাথরুমে গিয়ে শয়তানটাকে গোসল করিয়ে, নতুন জামা পরিয়ে আবার সোজা লিফটে উঠে পড়বেন। আর এই নেন শার্ট, জামা। কোথায় পেলে এই সাইজের জামা, ইদ্রিস মিয়া বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে।

মিষ্টি মেয়ে রিমঝিম বলে উঠে, কেন এইগুলি আমার ঠাকুর দাদার, বলতেই নন্দিনী তার মুখ চেপে ধরে আর বলে, এইগুলি আমার প্রয়াত বাবার, অসুবিধা হবে না, ধুয়ে ইস্ত্রি করে রেখেছি। গোসল সেরে, মাদ্দোর অমুসলিমের জামা গায়ে দিতে অনিহা দেখতে পেয়ে ইদ্রিস মিয়া বলে ওঠে, মনে রেখ, ‘জান বাঁচানোর জন্য শুয়োরের মাংসও হালাল।’ গোসল শেষে, নতুন জামা গায়ে দিয়ে মাদ্দো, ইদ্রিস মিয়ার নতুন কেনা টয়োটা ফিল্ডার গাড়ীতে চড়ে আদেশের সুরে বলে, ড্রাইভার সাহেব গাড়িটা ঘুড়িয়ে বন্দরের দিকে চলো, আজ গাজীসাহেবের বাসায় মেজবানের দাওয়াত আছে। ও কতোদিন হল, মেজবান খেয়েছি, ‘ইদ্রিস মিয়া চলন্ত গাড়ির জানালায় বাতাস খেতে খেতে জিব্বাটা চাটতে চাটতে ভাবতে থাকে।’

বিশাল আয়োজন চলছে, শহরের এই প্রান্তে। কমিউনিটি হলের গেইটে দাঁড়িয়ে গাজী সাহেব নিজেই সবাইকে অভ্যার্তনা জানাচ্ছেন, তার সাথে আছেন তাঁর সদ্য ডিভোর্সপ্রাপ্ত কন্যা, দুই সন্তানের জননী জাহানারা। জাহানারাকে দেখেই লুইচ্চা ইদ্রিস মিয়ার চোখের পলক যেন আর পড়তে চায় না। মাদ্দো, ইদ্রিস মিয়ার পিঠে চিমটি দিয়ে, কানে কানে বলে, এইটার কথাই তোমাকে বলেছিলাম আর কি। ইদ্রিস মিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে হাসে, হাসির সাথে কিছু লোলুপ লালাও ঝরে পড়ে।

মেইজবাইন্নে মাংস খেতে খেতে, মাদ্দো যেন মূহুর্তেই তরতাজা হয়ে উঠে, সে চোখ ধাঁধানো সিল্কের পাঞ্জাবী গায়ে দেয়া গাজী সাহেবকে, ইদ্রিস মিয়ার দিয়ে তাকিয়ে কিছু একটা বলছে আর দু’হাত দুদিকে বারবার ছড়িয়ে দিচ্ছে, ভাবগতিতে মনে হচ্ছে, তিনি বলতে চাচ্ছেন, তাঁর অর্থাৎ ইদ্রিস মিয়ার টরেন্টো শহরে বিশাল অট্টালিকা আছে, গাড়ি আছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। মাদ্দোর মুখে, নিজের অর্থ-বৈভবের গুণকীর্তন আঁচ করতে পেরে, ইদ্রিস মিয়া আরও গোগ্রাসে গোমাংস গ্রাস করতে থাকে। এভাবে একসময় খারাপ লাগছে বলতে বলতে, সে পাশের অথিতির কোলেই ঢলে পড়ে। মাদ্দো আর গাজী সাহেব আধাপেট খেয়ে উঠে, ইদ্রিস মিয়াকে ফ্লোরে শুইয়ে দেয়। ওদিকে, সদ্য তালাকপ্রাপ্ত কন্যা জাহানারা, ইদ্রিস মিয়ার মাথায় পানি ঢালতেই, ইদ্রিস মিয়ার সেন্স ফিরে আর উপস্থিত সবাই সরগোল শুরু করে দেয়। সবার মুখে একটিই কথা, ইদ্রিস মিয়া আসলে, জাহানারার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যই এমন ভান ধরেছে। আর জাহানারার এতোসব সেবা যত্নের শুধু একটিই উদ্দেশ্য, যে কোন ভাবে এই আয় বুড়োটাকে বিয়ে করে, কানাডায় পাড়ি জমিয়ে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত নিশ্চিত করা।

এভাবে ঢলাঢলি করিতে, করিতে চুয়াত্তর বছরের ইদ্রিস মিয়ার সাথে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্ক্রেপ-জাহাজের ব্যবসায়ী, গাজী সালেহ উদ্দিন আহমেদের পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি(ইদ্রিস মিয়ার কন্যার বয়সী) সুন্দরী কন্যার বিবাহের দিন ধার্য হইল। ইদ্রিস মিয়ার বিয়ের কথা, আটলান্টিক পাড়ি দিতেই, ইদ্রিস মিয়ার স্ত্রী ও স্কুল জীবনের সাথি, মিনা চৌধুরী মুহূর্তেই মূর্ছা গেলেন এবং জ্ঞান ফিরে ইদ্রিস মিয়ার মৃত্যূ কামনা করিলেন। তবুও ইদ্রিস মিয়া থেমে থাকার পাত্র নয়, তিনি পঞ্চাশ লক্ষ টাকার দেড়মোহড়ের বিনিময়ে বিশাল বোঝাটা প্রমত্ত হৃদয়ে গলায় ঝুলাইলেন। কিন্তু চরম পরিতাপের বিষয় এই যে, বিবাহের প্রায় একটি মাস পার হইলেও, জনাব ইদ্রিস মিয়ার সাথে জাহানারা বেগমের মধুর মিলন আর সম্ভব হইয়া উঠিল না। মাদ্দো, এদিক সেদিক দৌড়াইয়া, এই বৈদ্দ্য, সেই বৈদ্দ্যের ওষুধ কিনিয়া বৃথা চেষ্টা করিলেন এবং বিশাল অংকের কমিশন গোপনে নিজের পকেটে ঢুকাইলেন। অবশেষে বন্দর নগরীর প্রসিদ্ধ একজন হোমিও-চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি সিরাপ আনিয়া, ইদ্রিস মিয়ার নড়বড়ে যন্ত্রটার চেতনা ফিরিয়া আনিলেন মাত্র। তাই এইবার ইদ্রিস মিয়ার উৎসাহ দেখিয়া, মাদ্দো, ইদ্রিস মিয়ার দাম্পত্য স্বপ্ন পুরণ করিতেই ভায়েগ্রা ট্যাবলেট যোগাড় করিয়া আনিলেন। সেই ভায়েগ্রা গলাধারণ করিতেই, স্ত্রী সম্ভোগ করিয়া পরের দিন সকালেই ইদ্রিস মিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। মৃত্যূর পূর্বে তাঁহার একমাত্র বিনীত মিনতী ছিলো এই, আমার জানাজার সময় এবং কবরের কাছে পিছে কোথাও যেন এই সাক্ষাত আজরাইল, আবুল বশর ওরফে মাদ্দো, যেন অবস্থান করিতে না পারে।

ইতি

কানাডিয়ান ইদ্রিস মিয়া

১৬ই নভেম্বর, ২০২২

রম্য রচনা